বিভূতি ভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম দিনে বিশেষ লেখা

                                                          আমার কলমে  বিভূতি

     


                          


   আদি প্রাণের আধুনিক বন্দনাকার বিভূতিভূষণ নাকি নিসর্গ চেতনার বাতিঘর বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়- এরকম নানাভাবে, বিভিন্ন অভিধায় তাকে অভিহিত করা যায়, যেতে পারে। কোনটাই অতিকথন বা অতিমূল্যায়ণ দোষে দুষ্ট হবে না হয়ত। বাংলা ভাষার সেই মহান কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ সেপ্টম্বর পশ্চিমবঙ্গের চবিবশ পরগনা জেলার কাঁচরাপাড়ার নিকটবর্তী ঘোষপাড়া-মুরারিপুর গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। মানুষের মহান কথাকারের স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, তিনি ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আমার একজন প্রিয় লেখক বিভূতিভূষণ সম্পর্কে আরেকজন প্রিয় কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের আলোকিত বচন মনে পড়ছে, তিনি বলছেন,‘তুচ্ছের মধ্যে অমৃতের সন্ধান করে গেছেন বিভূতিভূষণ। কীভাবে তা মিলতে পারে অমৃতের স্বাদ নিতে নিতেই আমাদের তা জানিয়ে গেছেন। আমাদের নিজেদের অমৃত মিলুক আর না মিলুক, তাঁর লেখা পড়েই বুঝতে পারি সমস্ত জীবনে তাঁর এ বস্তুর গরমিল হয়নি।সাহিত্য সমালোচকগণ বলছেন, বিভূতিভূষণ যে মানবজগৎ সৃষ্টি করেছিলেন তা সারল্যে অসাধারণ। সনাতন গ্রামবাংলার জনজীবনের চিরায়ত ছবি তিনি এঁকেছেন নিপুণ, দক্ষ শিল্পকুশলতায়। গভীর মমতায়, শ্রমে তিনি এই কীর্তি স্থাপন করে গেছেন। কথাশিল্পী হিসেবে আশ্চর্যরকম সফল তিনি। গ্রামীণ জীবনের শান্ত, সরল, স্নিগ্ধ ও বিশ্বস্ত ছবি ফুটে ওঠে তাঁর নিরাসক্ত কথকতা ও বয়ানে, চুম্বকের মতো টেনে নেয় পাঠককে। মুগ্ধ করে, বিস্মিত করে। অথচ পথের পাঁচালী, অপরাজিত, আরণ্যক, ইছামতির মতো অসামান্য সব উপন্যাসের রচয়িতা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখালেখির জীবন ছিল স্বল্প। মাত্র আঠাশ বছর। এই লেখকের আয়ু ছিল মাত্র ৫৬ বছর।

  ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম বিভাগে আইএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে বিএ পরীক্ষায়ও ডিস্টিংশনসহ পাশ করেন। এরপর তিনি কিছুদিন এম.এ এবং ল-ক্লাসে লেখাপড়া করেন। উল্লেখ্য, তিনি তাঁর তৃতীয় বার্ষিক পরীক্ষার সময় বসিরহাটের মোক্তার কালীভূষণ মুখোপাধ্যায়ের কন্যা গৌরী দেবীকে বিবাহ করেন। কিছুদিন পর এই স্ত্রী কলেরা রোগে মৃত্যুবরণ করেন। স্ত্রীর শোকে তিনি কিছুদিন প্রায় সন্ন্যাসীর মতো জীবনযাপন করেন। এরপর তাঁর লেখাপড়ার সমাপ্তি ঘটে। এই সময় তিনি হুগলি জেলার জাঙ্গীপাড়ায় মাইনর স্কুলে শিক্ষাকতা শুরু করেন। কিন্তু সেখানে তিনি অস্থিরতায় কাতর হয়ে, সোনারপুর হরিণাভিতে শিক্ষকতার চাকরি নিয়ে যান। এখানে থাকতেই তিনি প্রথম 'উপেক্ষিতা' নামক গল্প রচনা করেন। এবং গল্পের সূত্রে তাঁর সাহিত্যিক জীবনের শুরু হয়। গল্পটি প্রবাসী পত্রিকার ১৩২৮ বঙ্গাব্দের মাঘ সংখ্যায়(১৯২১ খ্রিষ্টাব্দ) প্রকাশিত হয়েছিল। এরপর তিনি খেলাতচন্দ্র মেমোরিয়াল স্কুলে শিক্ষকতা করেন। এই সময় স্ত্রীর শোকে গভীরভাবে পরলোকতত্ত্ব চর্চা শুরু করেন।


 বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের ৩ ডিসেম্বর (১৭ অগ্রহায়ণ, ১৩৪৭ বঙ্গাব্দ), ফরিদপুর জেলার ছয়গাঁও নিবাসী ষোড়শীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের দ্বিতীয়া কন্যা রমা দেবীকে (ডাক নাম কল্যাণী) বিবাহ করেন। ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয় যুদ্ধের সময় তিনি খেলাতচন্দ্র মেমোরিয়াল স্কুল ছেড়ে দেশে ফিরে আসেন এবং এখানকার গোপালনগর স্কুলে শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। এই সময় তিনি পৈতৃক ভিটার কাছে একটি পুরানো বাড়ি কেনেন এবং এই বাড়ি মেরামত করে সস্ত্রীক বসবাস শুরু করেন। বিয়ের পর তাঁর দুটি মৃত কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করে। এরপর পুত্র তারাদাস বন্দোপাধ্যায় (ডাকনাম বাবলু) জন্মগ্রহণ করেন। সংসার জীবনে তিনি তাঁর পিতার মতোই কিছুটা ভবঘুরে জীবনযাপন করেন। ১৯৪২-৪৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত, তিনি বন্ধু এবং বিহার সরকারের বন বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মচরী যোগেন্দ্রনাথ সিন্হার সাথে ছোটনাগপুর বিভাগের সিংভূম, হাজারীবাগ এবং রাঁচী ও মানভূম জেলার অরণ্য ভ্রমণ করেন। এছাড়া দুই-একবার তিনি সারান্দা বনের নিভৃত অরণ্যে বাস করেন।


  তাঁর রচনাসম্ভারের মধ্যে রয়েছে ১৫টি উপন্যাস, সাতখানা কিশোর উপন্যাস, দুইশ’র বেশি ছোটগল্প। পনেরোটি উপন্যাসের মধ্যে একটি ছিল অসমাপ্ত।শিশু-কিশোর উপন্যাসের মধ্যে তিনটি হলো বয়স্কপাঠ্য উপন্যাসের কিশোর সংস্করণ। এসবের বাইরে অন্যান্য বিষয়েও তিনি লিখে গেছেন। সেগুলোর সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। তার মধ্যে রয়েছে ভ্রমণকাহিনী, ডায়েরি, প্রবন্ধ, অনুবাদ। ব্যাকরণ বইও তিনি লিখেছেন। উপন্যাস ও ছোটগল্প, ভ্রমণ-দিনলিপি এবং কিশোরদের উপযোগী রচনা-গদ্য সাহিত্যে এ চারটি কীর্তিস্তম্ভের ওপর বিভূতিভূষণের সাহিত্যিক কৃতিত্ব। এ চারটি কিন্তু একে অপরের থেকে কোনো অর্থেই ভিন্ন নয়। সুরে, বিষয়-নির্বাচনে, প্রশান্ত চিত্তের সহৃদয়তায় এগুলো যেমন সরস তেমনি জীবনরসে পূর্ণ।

 

 ইংরেজ শাসনের অব্যবহিত ফল হিসেবে বাংলাদেশে যে সাহিত্যের জন্ম, রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত যার বিস্তার। তাকে বাংলা সাহিত্যের ‘স্বর্ণযুগ’ বলা যাক বা না যাক, মার্কসীয় পদ্ধতিতে তার বিচার করতে গেলে আমাদের মনে রাখতে হবে, মার্কসবাদী-লেনিনবাদী সাহিত্যবিচারের মূল সূত্র : সাহিত্য হচ্ছে সামাজিক বাস্তবের প্রতিফলন, সমাজের স্তরে স্তরে শ্রেণী সংঘর্ষের প্রভাবে নিত্য যে আলোড়ন চলছে, বিভিন্ন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বিভিন্নভাবে তাতে সাড়া দেয়। এই শ্রেণীদ্বন্দ্বের ভেতর দিয়ে নির্বাচিত হয় সমাজের বিন্যাস কীভাবে পরিবর্তিত হয়, এ সমাজের গতি যাবে কোন দিকে। সাহিত্য এই শ্রেণীচেতনা হতে সৃষ্ট হয়ে সামাজিক পরিবেশের ওপর প্রতিঘাত করে। ‘লেখকমাত্রই মেধাবী’ কথাটি নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে সাহিত্য বোদ্ধামহলে। তবে একজন লেখক যে প্রখর আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন হবেন তা নিয়ে সন্দেহ থাকার কথা নয়। একজন বড় সাহিত্যিকের ‘টোটাল’ পরিচয় নিহিত থাকে তার সাহিত্যকর্মের ব্যাপ্তি ও বহুমুখীনতায়। বহুবিধ সংযোগ ও লিখন প্রতিভার গুণে একজন সৎ সাহিত্যিক নিজের জন্য পাঠক-বোদ্ধামহলে স্থায়ী আসন করে নিতে সম। এ ক্ষেত্রে লেখক তার চারিত অভিজ্ঞানের বিস্তৃতি ঘটান তার সৃষ্টিকর্মে। সমাজ, রাষ্ট্র, পরিবেশ, প্রতিবেশ, অর্থনীতি থেকে শুরু করে সমাজের প্রতিটি স্তরের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়াবলী তাকে পরিমার্জিত শৈলীতে উপস্থাপন করতে হয় তার সাহিত্যে। যাপনের এমন কোনো বিষয়-আশয় নেই যা একজন সাহিত্যিক স্পর্শ করতে অম। যে কারণে সৎ সাহিত্যিকের হাতে রচিত সাহিত্যকর্ম যুগ যুগ ধরে পাঠক তার অন্তঃস্থলে ধরে রাখে। অনেক সময় দেখা যায়, আপাতসরল দৃষ্টিতে সমাজ সম্পর্কে উদাসীন সাহিত্যিকের রচনাতেও গভীরভাবে উঠে আসে তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার অনুপুঙ্খ বাস্তবতা। এক্ষেত্রে সাহিত্যিক অনেকটা অজ্ঞাতসারেই তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে সম হন। এরূপ রচনা পাঠে আলোচকরা প্রথমদিকে রচনাটির শিল্পমূল্য নিয়ে সংশয় প্রকাশ করলেও সেটির নিবিড় পাঠ ও পর্যালোচনায় আবিস্কৃত হয় অপরিমেয় শিল্পমূল্য এবং সমাজ মূল্য। এ ধরণের সাহিত্য পাঠে সাহিত্যিকের এক ধরণের নিরীক্ষাপ্রবণ মানসিকতার সঙ্গে পাঠকের পরিচয় ঘটে। উন্মেষ ঘটে লেখকের শ্রেণীসচেতনতার। লিখনীতে মানব-সংসারের বিচিত্রতা তেমনভাবে ফুটে ওঠেনি এমন অভিঘাতে জর্জরিত হতে হয় ‘পথের পাঁচালী’র অমর রূপকার বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তাহলে প্রশ্ন জাগে- বিভূতিভূষণ কি শ্রেণীচেতন ছিলেন না? মানুষের জীবন-যাপনের প্রতিমুহূর্তের বিবর্তিত অবস্থা, সংঘাত জানতেন না তিনি? প্রকৃতার্থে বিভূতিভূষণ রচিত উপন্যাস কিংবা ছোটগল্পের চরিত্র স্থান, কাল, পাত্র সমন্বয়িত হতে দেখা যায় সুষম বিন্যাসে। উপন্যাসিক হিসাবে বিভূতিভূষণের খ্যাতি বেশি হলেও তার গল্পগুলোতে আবেগঘন পরিস্থিতির প্রাধান্য থাকায় সমকালীন অনেক সমালোচক তার ব্যাপারে ঔদাসীন্য দেখিয়েছেন। সমাজতন্ত্রবাদী লেখক ও সমালোচকরাও তাকে এড়িয়ে গেছেন। অথচ তার ‘মেঘ মল্লার’ (১৯৩১), ‘মৌরীফুল’ (১৯৩২), ‘জন্ম ও মৃত্যু’ (১৯৩৮), ‘নবাগত’ (১৯৪৪) গ্রন্থের গল্পগুলো শ্রেণীচেতন বিভায় সমুজ্বল। বিভূতিভূষণের রচনাতে একদিকে যেমন ফুটে ওঠে শ্রেণী-বৈষম্য তেমনি রয়েছে নর-নারীর শ্বাশত রোমান্টিকতা। রয়েছে প্রকৃতি অবলোকনের অপূর্ব দর্শন। ইউরোপ-আমেরিকার নবজীবন-চেতনার প্রবাহ এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তীকালে সামাজিক ও নৈতিক অবস্থার পরিবর্তনের প্রবল হাওয়ায় তৎকালীন ভারতের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে নাগরিক জীবনের আলোড়ন, আক্ষেপ, হতাশা নানামুখী বৈশিষ্ট্য নিয়ে তার রচনাশৈলীতে স্পষ্টভাবেই মুদ্রিত। 

 নিভৃতচারী এই কথাশিল্পীই রচনায় পল্লীর জীবন ও নিসর্গ রূপায়ণে বাংলার আবহমানকালের চালচিত্র ও মানবজীবনের অন্তর্লীন সত্তা প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর রচনায় প্রকৃতি কেবল প্রকৃতিরূপেই আবির্ভূত হয়নি, বরং প্রকৃতি ও মানবজীবন একীভূত হয়ে অভিনব রসমূর্তি ধারণ করেছে। মানুষ যে প্রকৃতিরই সন্তান এ সত্য তাঁর বিভিন্ন রচনায় প্রতিফলিত হয়েছে। প্রকৃতির লতাপাতা, ঘাস, পোকামাকড় সবকিছুই গুরুত্বের সঙ্গে স্বস্বভাবে তাঁর রচনায় স্থান পেয়েছে। প্রকৃতির অনুপুঙ্খ বর্ণনার মধ্য দিয়ে বিভূতিভূষণ গভীর জীবনদৃষ্টিকেও তুলে ধরেছেন। তবে তাঁর রচনায় নিম্ন মধ্যবিত্ত বাঙালির জীনবচিত্র ও সমকালের আর্থসামাজিক বাস্তবতাও সমভাবে উন্মোচিত হয়েছে। তাই বাংলা কথাসাহিত্যে শরৎচন্দ্রের পরে বিভূতিভূষণই সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় সাহিত্যিকের মর্যাদা পেয়েছেন।


 বিভূতিভূষণ আপাদমস্তক একজন প্রকৃতিপ্রেমিক। তিনি অরণ্য-জঙ্গল-ঝোপঝাড়ের গাছ-গাছালির মধুর সৌন্দর্য শুধু নিজেই বিমুগ্ধ হয়ে উপভোগ করেননি, পাঠকদের কাছেও সেই সুন্দর মনোহর রূপটি তুলে ধরেছেন। তার উপন্যাস পড়ার পর পাঠক এতটাই অভিভূত ও তৃপ্ত হন যে বিভূতিভূষণের বর্ণিত অপরূপ ছবি নিজের চোখে না দেখলেও তা জীবন্ত হয়ে তাদের মনের পর্দায় ভেসে থাকে। এ কথা যেমন 'পথের পাঁচালী'র বেলায় সত্য তেমনি সত্য 'আরণ্যক' বা 'ইছামতী'র বেলায়ও। ‘পথের পাঁচালী’ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনন্য কীর্তি। বিশ্বনন্দিত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় এটির চলচ্চিত্রায়ন করেন। ফলে এই উপন্যাসের খ্যাতির পরিধি বহির্বিশ্বেও ছড়িয়ে পড়ে। বিভূতিভূষণ সাহিত্য অঙ্গনে প্রবেশ করেন এই উপন্যাসটির মধ্য দিয়েই। এটিই তাঁর প্রথম উপন্যাস, একই সঙ্গে প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থও। পথের পাঁচালী প্রথমে ধারাবাহিকভাবে বের হয়েছিল মাসিকপত্র ‘বিচিত্রা’য়। এক বছরেরও বেশি সময় লেগেছিল এতে। বই আকারে এটি বের হয় ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে, ১৩৩৬ বঙ্গাব্দের আশ্বিন মাসে। এ বই বেরুবার আগে সাময়িকপত্রে এই লেখকের কয়েকটি ছোটগল্প প্রকাশিত হয়। লেখক হিসেবে সামান্য পরিচিতি ছিল তখন। সেই সময় এ বিশাল আয়তন উপন্যাসের প্রকাশক জোগাড় করার কাজটি সহজ ছিল না। ঝুঁকি নিয়ে এ দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছিলেন সজনীকান্ত দাস। তার নিজস্ব কোনো প্রকাশনা সংস্থা ছিল না। শুধু এ বইটা বের করার জন্যই তিনি ‘রঞ্জন প্রকাশালয়’ প্রতিষ্ঠা করেন। ‘পথের পাঁচালী’ বই হিসেবে বেরুবার আগেই বিচিত্রা পত্রিকায় এর বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হতে থাকে। সেই বিজ্ঞাপনে বলা হয়, বইটির দাম রাখা হবে তিন টাকা। বিজ্ঞাপন ছিল এরকম : “শ্রীবিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত বাঙলা ভাষায় সম্পূর্ণ নূতন ধরনের উপন্যাস। শিশুমনের দুর্জ্ঞেয় রহস্য ইতিপূর্বে আর কেহ এদেশে এরূপভাবে উদ্ঘাটিত করেন নাই; অন্য দেশেও কেহ করিয়াছেন কি না আমাদের জানা নাই। উপন্যাসখানি ‘বিচিত্রা’য় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হইতেছে। ইতিমধ্যেই সাহিত্য-রসিক মহলে ইহার সম্বন্ধে বিস্তর আলোচনা হইয়াছে।”রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাস সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন যে, ‘বইখানা দাঁড়িয়ে আছে আপন সত্যের জোরে।’


 বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যক’ আমার প্রিয় উপন্যাস। যখন জঙ্গলমহালের কর্মরত ছিলেন, তখনই ভেবেছিলেন অরণ্যজীবনসংশ্লিষ্ট কাহিনী লেখার কথা। অনেকে মনে করেন, ‘আরণ্যক’ হচ্ছে তাঁর শ্রেষ্ঠ লেখা। ‘স্মৃতির রেখা’ নামের দিনলিপিতে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেনও সেকথা।বিভূতিভূষণ জানতেন মানুষ একসময় অরণ্য থেকে বহুদূরে চলে যাবে তাদের নগরায়ণের নামে এক ধ্বংসলীলার দিকে। তাদের সেই ভবিষ্যৎ জীবনের কথা ভেবে তিনি রচনা করে গেছেন প্রকৃতির অকৃত্রিম উপাদান ‘আরণ্যক’ উপন্যাসটি। যেখানে মানুষ খুঁজে পাবে তার আসল গন্তব্য এবং সত্যিকারের আশ্রয়ের ঠিকানা। কারণ মানুষ প্রকৃতি ছাড়া বেঁচে থাকতে পারে না। প্রকৃতিই তার আসল সঙ্গী। জল যেমন যেতে চায় জলের কাছে তেমনই মানুষও যেতে চায় প্রকৃতির মাঝে। নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পায় সে। প্রকৃতি আর মানুষের মধ্যে এভাবেই তো গড়ে উঠেছে আদিম প্রেম এবং যৌথ জীবনের সংসার। ‘আরণ্যক’ উপন্যাসে মানুষ আর প্রকৃতির নিজস্ব নিঃসঙ্গতাও ফুটে উঠেছে। যেখানে শরীরের প্রয়োজনে শরীর নেই কিন্তু মনের প্রয়োজনে মন আছে। সত্যিকথা বলতে বিভূতি সবসময় তার একটি ব্যক্তিগত জগৎ-কে তৈরি করতে চেয়েছেন। যেখানে সব কিছুই সুন্দর, আবার সব কিছুই অসুন্দর। যেখানে প্রেম আছে আবার তীব্র ঘৃণা আছে। সব মিলে একটা ব্যক্তিগত পুরাণ ভেসে ওঠে তার চিত্রকল্পে। প্রকৃতির গভীর ভালোবাসাকে সে গ্রহণ করতে চেয়েছেন নিজস্ব কৌশলে। যার কিছুটা স্বাদ পাঠকও লাভ করে উপন্যাসটি পড়ে। কিন্তু মানুষ দিনে দিনে যান্ত্রিক হয়ে উঠছে। গ্রাম হয়ে উঠছে আধুনিক শহর। বন উজাড় করে তৈরি হচ্ছে ফসলের মাঠ। যতো সময় যাচ্ছে আমরা আমাদের মনের মতো প্রকৃতির সবুজকেও হারাচ্ছি। বন্য পশুপাখি হারাচ্ছে তাদের নিরাপদ আশ্রয়। সবমিলে আমরা যাচ্ছি কেথায়? ধ্বংসের দিকে! বিভূতি যদিও তার উপন্যাসে এই সত্যের প্রকাশ এতো পরিষ্কারভাবে করেননি। তিনি প্রকৃতির প্রেম, প্রকৃতির নিজস্বতা, প্রকৃতির সাথে সাথে মানুষের সম্পর্ককে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। আসলে শিল্পের রস শিল্পেই থাকে। তাকে গ্রহণ করতে হয় শৈল্পিকভাবে।


 অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছেন,“এমন প্রকৃতি-পাগল সাহিত্যিক বাংলা সাহিত্যে বিরল। প্রকৃতিকে চোখে দেখে ভালো লাগে না কার কিন্তু তাকে ভালোবেসে তার গভীরে অবগাহন করা অন্য জিনিস। বিভূতিকে সেই জন্যে বছরে কয়েকমাস অরণ্যবাস করতে হতো। আর কয়েক মাস পল্লীর কোলে কাটাতে হতো। ইছামতী নদীর কূলে। তাঁর জীবনের যুগল মেরু ছিল অরণ্য ও দক্ষিণায়ন। শহরে থাকলেও তিনি শহুরে ছিলেন না। কোনোদিন হতে চাননি। নাগরিক সভ্যতা তাকে বশ করতে পারেনি। তার পোশাকে-আশাকে নাগরিকতার লেশ ছিল না। বৈঠকখানায় তিনি বেমানান। চিড়িয়াখানায় যেমন চিড়িয়া।”


 মহান কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর (১৫ কার্তিক ১৩৫৭) বুধবার, রাত্রি ৮টা ১৫ মিনিটে বিহারের (বর্তমানে ঝাড়খণ্ড) ঘাটশিলায় মৃত্যুবরণ করেন।

 আবির ভট্টাচার্য

Post a Comment

1 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.
  1. শত কোটি প্রণাম।অসাধারণ লেখা হয়ছে।এক কবির জন্ম দিনে এভাবে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে হয়। আপনিও নমস্য ব্যক্তি

    ReplyDelete